রতনতনু ঘাটীর পরিচিতি
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছোটোদের জন্যে মনকাড়া ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখেন। একালের একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক। তাঁর লেখা রূপকথা পড়তে পড়তে ছোটদের মনে হয়, তিনি যেন তাদের পাশে বসে গল্প বলছেন!
কমিক চরিত্র টিনটিন-ক্যালকুলাসদের সঙ্গে কুশল, আগমনি, বিপ্লব, অর্ক আর অয়ন্ন্দুদেরনিয়ে তাঁর
জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি কিশোরদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
এ পর্যন্ত তাঁর ষাটটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পনেরোটি কিশোর গ্রন্থ। ইংরেজি ও ওড়িয়া ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে।
শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘কমিকস দ্বীপে টিনটিন’ বইটির জন্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার’।
পেয়েছেন দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া--কলকাতা এবং পারুল প্রকাশনীর যৌথ ‘শিশুসাহিত্য পুরস্কার’, হলদিয়া পৌরসভা কর্তৃক নাগরিক সংবর্ধনা এবং শিশুসাহিত্য সম্মাননা।
এ ছাড়া পেয়েছেন‘আন্তজার্তিক রূপসীবাংলা পুরস্কার’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মৃতি পুরস্কার’ মেদিনীপুর রত্ন সম্মান’ ও আরও অনেক পুরস্কার।
অলীক সফটওয়্যার কোম্পানি
অনেকদিন পরে আজ অনিলেশের সঙ্গে দেখা
তেরো মাথার মোড়েরউদয়পদ্ম গাছটার নীচে।
অনিলেশ বলল, ও নাকি রোজ এখান থেকেই
সেক্টর নাইন্টি-নাইনের বাস ধরে,
ওর কোম্পানির নাম অলীক সফটওয়্যার।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলাম,
এ কি সেই অনিলেশ,যে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়
আমার একটা সুগন্ধি ইরেজার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি?
ওর হাতের টিফিনবক্সের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালাম?
অনিলেশ বলল, এতে নানা রঙের রূপকথা ভরে দিয়েছে ওর বউ।
বাইরে কিচ্ছু খেতে দেয় না,
তাইএইসব রূপকথা খেয়েই ওর সারাদিন কাটে!
আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম,
এ কি সেই অনিলেশ,যে মেয়েদের সামনে
নিজের নামটাইঠিকঠাক মনে করতে পারত না?
একথা-ওকথার পিঠে জানতে চাইলাম, ছেলেমেয়েরা?
অনিলেশ বলল, এক ছেলে দুন স্কুলে পড়ে,
ওর বিষয় ভোরবেলার স্বপ্ন!
আর এক মেয়ে বিকেলবেলার রামধনু নিয়ে
বিশ্বভারতীতে মাস্টার্স করছে, সেকেন্ড ইয়ার।
আমি মনে মনে বললাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যে অঙ্কে তেরো পেত,আর বাংলায়
কখনও ভাবসম্প্রসারণ লিখতেই পারত না?
বললাম, কদম্বগাছিতে থাকিস,
ওখানে ফ্ল্যাট না নিজের বাড়ি?
অনিলেশ বলল, যমুনাবতী নদীর পাড়ে
মধুমঞ্জরী লতায় ঢাকাদোতলা বাড়িটাই তো,
বাড়ির নাম আকাশকুসুম!
আমার মনে পড়ে গেল, যে ছেলেটা খালধারের হতকুচ্ছিত
একটা বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকত, এ কি সেই অনিলেশ?
জানতে চাইলাম, এতটা পথ... গাড়িটাড়িকিনিসনি?
ও বলল, ওর দুটো গাড়ি আছে,
একটার নাম পুষ্পক, আর-একটার নাম অন্তরীক্ষ!
গাড়িতে গেলে মানুষ একলা হয়ে যায়,
তাই বাসে যাতায়াত করে।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম,
এ কি সেই অনিলেশ, যার হাওয়াই চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে
অনেক দিন খালি পায়ে স্কুলে আসত?
বললাম, অফিস চলে গেলে বউ সারাদিন কিছু...
অনিলেশ জানাল, অফিস যাওয়ার সময় ও বউকে
নতুন কিছু করতে বলে যায়,
আর সরোদে-সেতারে, তানপুরায়-বেহালায়, বীণায়-এস্রাজে
ওর বউ সারাদিননতুন নতুন সুর রচনা করে।
শুনে আমি ভাবলাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যে ভুল বানানে মীতাক্ষরীকেপ্রেমপত্র লিখে
বাংলাস্যারের হাতে ধরা পড়ে বকুনি খেয়েছিল?
বললাম, মেসোমশাই, মানে এখন...
অনিলেশ বলল, ও, বলাই হয়নি!
বাবার মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল,
বাবা দিনেরবেলা আকাশে তিনটে সূর্য
আর রাতেরবেলা চারটে চাঁদ দেখতে পেত।
ছেলেমেয়ের পড়ার ক্ষতি হচ্ছিল,
তাই বাবাকে আর বাড়িতে রাখাই গেল না!
নিজের মনে বললাম, এ কি সেই অনিলেশ,
যার বই কিনে দেওয়ার জন্যেতার বাবা
লোকের বাড়ি-বাড়ি সাহায্য চাইতে যেতেন?
অনিলেশ চলে যাওয়ার জন্যে উসখুশ করছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, আর মাসিমা?
অনিলেশ বলল, আর বলিস না!
সংসারে মানিয়ে নিতে পারল না বলে
মাকে একটা বৃদ্ধাবাসে রেখে এসেছি।
ওখানে কাগজের ঠোঙা তৈরির টাকায়
আমার এবারের জন্মদিনে মা একটা জামা পাঠিয়েছিল,
কিন্তু বিশ্বাস কর, এত অর্ডিনারি, জাস্ট পরা গেল না!
আমি চেঁচিয়ে বললাম, তুই কি সেই অনিলেশ,
যার জন্যে বাঁশের বেড়ার ঘরের দরজায়
মাসিমা ভাতের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সারাদিন?
আমার কথাগুলো শুনতেই পেল না, দৌড়ে বাসে উঠে গেল অনিলেশ,
অলীক সফটওয়্যার কোম্পানির ম্যানেজার।
·
আত্মহননের পাঠশালা
আমি কেমন করে যেন একদিন ওদের পাল্লায় পড়ে গেলাম!
ওদের মানে, ওই ঢ্যাঙা মঈদুল, হাতকাটা নিকুঞ্জ, ভোঁতকা অ্যালবার্ট...।
ওদের সঙ্গে দেখা হয় ভাঙা মন্দিরের পিছনের লতা-গুল্মের মধ্যে
দাঁত বের করা ব্যর্থ প্রাইমারি স্কুলের দরজাহীন অন্ধকার ক্লাসঘরে।
প্রতিদিন ওদের সঙ্গে দাদা-মতো নতুন একজন আসে,
সে আমার গালে পরপর তিন-চারটে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় মারে,
কখনও যাওয়ার সময় দমাস করে পাছায়লাথি মেরে চলে যায়।
একদিন এক দাদা একটা সিমেন্ট ভরতি বস্তা আমার পিঠে বেঁধে দিয়ে
মোরাম বিছানো রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলল।
তারপর বলল, ‘সাপের মতো বুকে হেঁটে হাফ কিলোমিটার এগিয়ে যা!’
পারলাম না দেখে আমার পিঠে শিলাবৃষ্টির হিসেবে দমাদ্দম লাথি আর ঘুসি!
যাওয়ার সময় আমার চুলের মুঠি ধরে বলে গেল, ‘এর বিষদাঁত ভেঙে দাও!’
দিলও তাই। বিষদাঁত মানে,ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল আমার মান-সম্মান,
আমার মাকে নিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে কুৎসিত কাঁচা খিস্তিকরল,
আমার বোনকে বখাটে গালাগালিতে চাঁদের এপিঠ-ওপিঠ করে ছাড়ল!
তারপর থেকে জরদ্গব ছেলেদের পিঠে বেঁধে চলেছি মাইন,
সাঁইসাঁই শব্দে আগ্নেয়গিরির দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি নিধুবন,
বাঁইবাঁই ভঙ্গিতে ঘটের কেষ্ট আর পটের কেষ্টকে ছুড়ে মারছি
চরাচরের আরও ওদিকের এক কুচ্ছিত লাভাস্রোতে,
কাঁইকাঁই করে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখছি মা-মাসির গরিয়সী স্তন্যদান।
আমাকে রোজ একটা অন্ধকার ঘরে অগুনতি মাইন গুনতে হয়
প্রথম থেকে শেষ, শেষ থেকে প্রথম।
বিস্ফোরকের গন্ধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে শেখাচ্ছি আজানুলম্বিতদের।
ভুসভুস করে বারুদের উর্ধ্বমুখী পোড়া গন্ধে
কাদের যেন ফুসফুস ভরিয়ে তুলতেবাধ্য করছি প্রতিদিন!
আমাকে ওরাআত্মহননের পাঠশালায় এনে ভরতি করে দিয়েছে।
বিস্ফোরক হয়ে ওঠার কঠিন পাঠ দিচ্ছে দিনের পর দিন!
কিন্তু ক’ দিন ধরে একটা বরাভয় ঢেউ এসেআনচান করে তুলছে আমাকে,
আমি টের পাচ্ছি,একটামারাত্মকবারুদগনগনিয়ে উঠছে আমার ভিতরে।
সে চিৎকার করে বলছে, ‘আমাকে ব্যবহার করো! আমাকে ব্যবহার করো!’
অমুকবাবু তমুকবাবু
আমাদের গ্রামের অমুকবাবু কথায় কথায় বাঘ মারেন,
আর তমুকবাবু দু’-তিনটে গ্রহকে এনে
রোজ-দিন বসিয়ে রাখেনতাঁর পুকুরঘাটের পাশে।
আমরা সেসব গল্প অবাক হয়ে মন দিয়ে শুনি
আর অন্য গ্রামের লোকজনের কাছে বলে বেড়াই,
হুঁ হুঁ! আমাদের গ্রামে অমুকবাবু আর তমুকবাবু থাকেন!
তারা জানতে চায়, অমুকবাবুর মারা বাঘ
কেউ কখনও চোখে দেখেছ?
তমুকবাবুর দাপটে মহাশূন্যে গ্রহের সংখ্যা কমে যায়নি?
আমরা ভিনগ্রামীদের সেসব কথায় কান দিই না।
অমুকবাবুর অঢেল পসয়া, কিন্তু তিনি গ্রামে
কোনওদিন একটাও রাস্তাঘাট তৈরি করে দেননি।
তমুকবাবুর বাড়িতে নাকি টাকা ছাপানোর মেশিন আছে।
কিন্তু তাঁর টাকায় একটাও হাসপাতাল গ্রামের মুখ দেখেনি।
অমুকবাবু আর তমুকবাবু আমাদের সুখে-দুঃখে থাকেন না
কিন্তু আমরা অভাব-অনটনের ফাঁকে ফাঁকে ওঁদের গল্প বলি।
একবার বন্যা হলে আমাদের গ্রাম থেকে ছ’ মাসেও জল সরে না।
এবার বন্যা হতেই শুনছি অমুকবাবু ঠিক করেছেন
সেই বন্যার জলে তিনি হাইব্রিড ইলিশের চাষ শুরু করবেন।
আর তমুকবাবু ক্যামেরা-লোকলশকর নিয়ে নেমে পড়েছেন
আমাদের বন্যা কবলিত গ্রাম নিয়ে সিনেমা বানাতে।
এখনও আমরা জল সাঁতরে লঙ্গরখানার দিকে যেতে যেতে
আমাদের গ্রামের অমুকবাবুর আর তমুকবাবুর গল্প করছি।